আত্মহত্যার পথে কৈশোর – মানুষ কেন আত্মহত্যা করে?

আত্মহত্যার পথে কৈশোর – মানুষ কেন আত্মহত্যা করে?

আত্মহত্যা অর্থাৎ নিজেকে হত্যা । নিজেই নিজেকে হত্যা, একবার ভেবে দেখুন নিজেই নিজেকে হত্যা করা যায় নাকি? মানুষ তো নিজেকে নিজের জীবণ কেই সব থেকে বেশি ভালোবাসে। আবার সেই মানুষ কিনা নিজেকেই হত্যা করে। আমাদের একটু কেটে গেলে কতো কষ্ট হয়, পড়ে গেলে কতো লাগে, তাহলে নিজেকে খুন করতে কত লাগে; কত কষ্ট হুয় বলুনত ?

ভাবুন তারপরেও মানুষ নিজেকে হত্যা করে। সভ্যতা যত উন্নতির দিকে এগিয়ে চলেছে এই আত্মহননের পরিসংখ্যান ততো নাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।

কারা নিজেকে বলি দিচ্ছে নিজেদের ভবলীলা সাঙ্গ করার জন্য? এর উত্তর আগের থেকে এখন অনেক বদলে গেছে। আর কষ্টটা সবথেকে বেশি এই বদলে যাওয়া উত্তরের জন্যই। কোলকাতা; শিলিগুড়ি; পুরুলিয়া সব জায়গা থেকেই আসছে উত্তর। কখনো ভালোবাসার উপেক্ষায়, কখনো টিউশন পড়তে না যেতে চাওয়ার জন্য মায়ের বকা খেয়ে ক্লাস অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রি তো কখনো আবার টিফিন খাওয়া নিয়ে বান্ধবিদের সাথে ঝগড়ার কারণে ১০ বছরের শিশু নিজেই নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে। চারিদিকে কেমন যেন শুরুতেই সমাপ্তির বাজনা। যত দিন যাচ্ছে ততো যেন আত্মহননের অন্ধকার ছায়া সমাজের সর্বস্তরের মানুষ কে গ্রাস করছে।

কিন্তু শুরুতেই শেষ কেন???

মনন্তত্ত্বের দিক থেকে দেখতে গেলে আত্মহননের গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল অবসাদ। যা মানুষের মনে বাসা বাধলে নিজেই নিজেকে শেষ করে দেবার ক্ষমতা লাভ করতে পারে। আর এখানেই প্রশ্ন উঠছে তবে কি অবসাদের কালো ছায়া এই শিশু মনগুলোকেও ছাড়ছে না। আজকের শৈশব কি তাহলে এটাই……..

কোথাও আমার আপনার সন্তানের মধ্যেও আত্মহননের কালোছায়া নেইতো???

WHO এর পরিসংখ্যান বলছে সারা বিশ্বে নাকি ৩০ কোটি মানুষ অবসাদে ভুগছে; এরমধ্যে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। জ্বর-সর্দির মতো একটা অসুখ এভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে কেন?

যদি ভারতীয় প্রেক্ষাপটে আমরা এর উত্তর নিতে চাই তাহলে বলব

(১) সচেতনতার অভাবঃ ভারতের প্রায় সর্বস্তরেই মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। মানসিক স্বাস্থ্য পরিসেবার যেমন অভাব রয়েছে তেমনি যেটুকু আছে সেখান থেকে পরিসেবা নেবার মানুষেরও অसাद য়েছে।

২) গুরুত্বের অভাব: আমাদের শরীরের মতো মনও যে আমাদের শরীরের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ সেটা আমরা অনেকেই মেনে নিতে চাইনা। শরীরের যেমন অসুখ করে এবং তার চিকিৎসার প্রয়োজন হয়, তেমনি মনেরও অসুস্থ হতে পারে তারও চিকিৎসার প্রয়োজন আছে এটা নিয়ে আমরা ভাবার প্রয়োজনই বোধ করিনা।

৩) সামাজিক চাপ: মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে জনমানসে সচেতনতার অভাবে সমস্যা পীড়িত মানুষের উপর একটা চাপ তৈরি করে যা তাকে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বিরত করে। মানুষ মনে করে এই ধরনের চিকিৎসা শুধু মায় পাগল দের জন্য অথবা যারা এই চিকিৎসা গ্রহণ করে তারা নিশ্চই পাগল।

তাই লোকে কি বলবে এই ভেবেই তারা আর চিকিৎসকের কাছে পৌঁছোতে পারে না। আর সেই সুযোগেই অবসাদ তাকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে।

এবার দেখে নেওয়া যাক শিশুদের আত্মহননের সম্ভাব্য কারণ কি হতে পারে।

(১) অবসাদঃ বর্তমান সময়ে সর্বক্ষেত্রেই শিশুদের উপর প্রতিযোগিতার একটা চাপ সর্বক্ষণ বিরাজমান এবং খেলাধূলার পর্যাপ্ত সময় না পাওয়ায় তাদের স্বাধীন চিন্তা ব্যাহত হচ্ছে তারা ধীরে ধীরে যেন যন্ত্রমানব হয়ে উঠছে আর এই পরিস্থিতিতেই শিশুদের মনে অবসাদের বাতাবরণ তৈরী হচ্ছে।

২) পারিবারিক একাত্মতার: পারিবারিক একাত্মতার অভাবে শিশু নিজেকে পরিবারের এক জন বলে মনে করতে পারেন৷ ফলে সে সবসময় নিরাপত্তা হীনতায় ভোগে।

৩) ত্রুটিপূর্ণ সামাজিকীকরণঃ সঠিক সামাজিকীকরণের মধ্য দিয়েই মানব মনে বোধের বিকাশ হয়। যে বোধ শক্তি তাকে তার জীবনকে ভালোবাসতে শেখায়। সমাজের বিভিন্ন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে শেখায়। এমনকি বিশেষ পরিস্থিতিতে নিজের সাথে নিজের লড়াই করতেও শেখায়। সামাজিক মূল্যবোধ সম্পর্কের গভীরতা, গুরুত্ব প্রভৃতি নানান বিষয়ে শিক্ষা লাভ করে যা, তার জীবনে একটি শত্রু ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে সাহায্য করে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় ত্রুটিপূর্ণ সামাজিকীকরণের ফলে সামাজিক ঘৃণাবোধ সম্পর্কের গভীরতা এমন কি নিজের জীবনের ভিত পর্যন্ত এতটাই ঠুনকো হয়ে ওঠে যে সহজেই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। খুব সাধারণ ঘটনাতেও এমন ছেলে মেয়েরা এমন ভাবে ভেঙে পড়ছে যে মৃত্যু ছাড়া তাদের কাছে আর কোন পথই খোলা থাকছে না।

এবার দেখে নেওয়া যাক কিভাবে এই সমস্যা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারি।

১) প্রত্যেক টা ছাত্র-ছাত্রির শেখার একটা নির্দিষ্ট ক্ষমতা আছে। প্রত্যেকের এ লেভেল আলাদা আলাদা। ফলে আমরা চাইলেই সবাই কে সব কিছু শেখাতে পারিনা। এটা আমাদের শিক্ষক-শিক্ষিকা, বাবা- মা সকলেরই বোঝা উচিৎ। আর এটা যদি আমরা বুঝতে না চাই এবং তাকে তার ক্ষমতার বাইরে বেরিয়ে চাপ দিয়ে কিছু শেখাবার চেষ্টা করি সেটা তো তার উপকারে আসবেই না বরং প্রতিনিয়ত ক্ষতিই হতে থাকবে।

২) বাবা মা দের নিজের সন্তান কে নিয়ে বিরাট উচ্চাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করা উচিৎ কারণ আপনার উচ্চাকাঙ্ক্ষা আপনার সন্তানের মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠতে পারে।
ভেবে দেখুন আপনার সন্তান হয়তো চাইছে কলা বিভাগে পড়াশোনা করতে, কিন্তু আপনি তা মেনে নিতে পারছেন না কারণ আপনার আত্মীয়, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব দের সন্তানরা সবাই হয়তো তথাকথিত ভালোকিছু নিয়ে পড়াশোনা করছে আপনার সন্তান যদি কলা বিভাগে পড়াশোনা করে তবে তাদের কাছে আপনার মাথা নিচু হয়ে যাবে। তাই আপনি জোর করেই ভালো কিছুতে ভর্তি করেছেন। দয়া করে এমন সিদ্ধান্ত নেবেন না। বাবা-মা এর একটা ভুল সিদ্ধান্ত একটি সন্তানের জীবন অন্ধকার করে দেবার জন্য যথেষ্ঠ।

৩) প্রত্যেকটা মানুষ আলাদা; তারা প্রত্যেকে স্বতন্ত্র; তাই আপনার সন্তানের সাথে কারো তুলনা চলেনা। তাই দয়া করে কারো সাথে কারো তুলনা না করে তার মধ্যেকার ভালো গুনগুলো খোজার চেষ্টা করে তার পূর্ণ বিকাশে সহায়তা করুন। ৪) স্বাধীন খেলাধুলাতে সাহায্য করুন। খেয়াল রাখুন কোন ভাবেই শিশু যেন খেলাধূনা থেকে বঞ্চিত না হয়।

৫) বাবা-মা এর ঝগড়া কখনই সন্তানের সামনে আনবেন না, তাতে সন্তান নিজেকে অসহায় মনে করে।

৬) সন্তানের কথা মন দিয়ে শুনুন তাকে বোঝার চেষ্টা করুন, তাকে পরিবারের একজন করে তুলুন। পরিবারের সুখ-দুঃখ বুঝতে শেখান।

(৭) সকলের সাথে মিশতে পারা একটা ভালোগুন, আপনার সন্তান কে সকলের সাথে মিশতে শেখান। যাবার ভাগ করে খেতে শেখান।

৮) সন্তান কোনকিছু চাইলে যে সাথে সাথেই দিতে হবে তার কোন মানে নেই তাকে বুঝিয়ে বলুন, ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে সেখান।

(৯) কোন কিছু অন্যভাবিক আচরণ দেখলে গুরুত্বহীন ভেবে উড়িয়ে দেবেন না। বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে মনোবিদের সাহায্য নিন।

*****
সৌমেন মণ্ডল

This Post Has One Comment

  1. Aditi Kundu

    খুব ভালো লেখা শেয়ার করেছেন ৷

Leave a Reply